লেখায় ও রেখায় জাতীয়তাবাদের বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা / উনবিংশ শতকে বিভিন্ন সাহিত্য ও অঙ্কিত চিত্র কিভাবে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটিয়েছিল

পৃথিবীর যেকোন দেশে স্বদেশ প্রেম ও জাতীয়তাবাদী ভাবধারা বিকাশের সঙ্গে সেই দেশের দেশাত্মবোধক জাতীয়তাবাদী সাহিত্যের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ট। উনিশ শতকের  দ্বিতীয়ার্ধে দেশাত্মবোধক সাহিত্যের বিকাশ ভারত ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, কাব্য, নাটক, উপন্যাস , প্রবন্ধ , সাহিত্যের প্রায় সব ক্ষেত্রেই সেদিন ছিল দেশপ্রেম । ভারতীয় চিত্রকলাতেও সেদিন স্বাদেশিকতা ছোঁয়া লেগেছিল । ভারতের জাতীয় জাগরনে এই সব গ্রন্থ এবং চিত্রকলার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম
       সাহিত্য -গ্রন্থ গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত আনন্দমঠ ; স্বামী বিবেকানন্দ রচিত বর্তমান ভারত ; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত গোরা এবং চিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ভারতমাতা চিত্র এবং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা বিভিন্ন ব্যঙ্গচিত্র  ।
A. সাহিত্য  : 
1.আনন্দমঠ (1882 ) : ভারতীয় জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত আনন্দমঠ উপন্যাস একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ । ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পটভূমিকায় রচিত আনন্দমঠ উপন্যাসে , জীবনের কোলাহল থেকে দূরে এক নিভৃত স্থানে একটি মঠ গঠনের কথা বলা হয়েছে । এই মঠে বসবাসকারী ত্যাগী সন্ন্যাসীরা দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য প্রাণ নিবেদন করেছেন । তাদের মূল লক্ষ্য আত্ম মুক্তি নয়- দেশ মাতৃকার মুক্তি ; উপন্যাসের ছত্রে ছত্রে মুক্তি সংগ্রামের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে আর এই বর্ণনার মধ্যে দিয়ে সাহিত্য সম্রাট দেশপ্রেমের আদর্শ ও নীতিবোধ কে জাতির সামনে তুলে ধরেছেন । বঙ্কিমচন্দ্র প্রদর্শিত এই আদর্শ ও ভাবাদর্শ অনুপ্রাণিত হয়ে দেশপ্রেমিকেরা দেশমাতৃকার মুক্তি জন্য নিজেদের নিয়োজিত করেছেন , যাদের কন্ঠে ধ্বনিত  হয়েছে আনন্দমঠ এর সেই অমোঘ বাণী "বন্দেমাতরম "
          রমেশ চন্দ্র মজুমদার  তাই আনন্দমঠ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন আর কোন বাংলা বই বা অন্য ভাষার কোন বই বাঙালি যুবকদের এত গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ করেনি ,  এই গ্রন্থ জাতীয়তাবাদের বেদ বাইবেল ও গীতা এর মূল কথাই হল দেশপ্রেম বিদ্রোহ বিপ্লব ও স্বাধীনতা।

2. বর্তমান ভারত (1905 ) : স্বামী বিবেকানন্দ রচিত বর্তমান ভারত গ্রন্থটি আকারে ক্ষুদ্র , স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের মতই সংক্ষিপ্ত এবং তার জীবনের মতই শক্তি ও সম্ভাবনায় স্পন্দিত,  এই গ্রন্থে স্বামীজি ভারত ও বিশ্বের ইতিহাস মন্থন করে ইতিহাসের গতি প্রকৃতি সম্পর্কে তার ধারনা কে সংহত আকারে প্রকাশ করেছেন । বর্তমান ভারত ধারাবাহিকভাবে প্রথম প্রকাশিত হয় উদ্বোধন পত্রিকায় , পরে স্বামী সারদানন্দ ভূমিকায় সেটি গ্রন্থের আকারে প্রকাশ পায় । এই গ্রন্থে তিনি যে মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন তা বিস্ময়কর,  ভারত ইতিহাস পাঠের মধ্য দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন যে ইতিহাস শ্রেণী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হয় । তার মতে পৃথিবীর সর্বত্রই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ,বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণ পর্যায়ক্রমে পৃথিবী শাসন করবে প্রথম দুই বর্ণের শাসনকাল শেষ হয়ে গেছে, তৃতীয় বর্ণ বৈশ্য  (বনিক/ইংরেজ) এর শাসনকাল সমাপ্তির মুখে,   চতুর্থ বর্ণ  শুদ্রের শাসনকাল অবশ্যম্ভাবী এবং তা ঐতিহাসিক সত্য । এই গ্রন্থে স্বামীজী তৎকালীন ইংরেজ শাসনের দোষ গুণ বিচার করে বলেছেন ইংরেজদের আগমন ভারতের আর্থিক উন্নতি ঘটেছে ঠিকই কিন্তু বিদেশি ভাবধারার প্রবেশে ভারতে কল্যাণকর  ও অকল্যাণকর মিশ্রভাব দেখা দিয়েছে,  তার মতে ভারতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংস্পর্শের সবথেকে  বিস্ময় ফল হলো ভারতবাসীর নির্বিচারে পাশ্চাত্য অনুসরণ । গ্রন্থের উপসংহারে তাই তিনি দেশবাসীকে স্বদেশ মন্ত্র উপহার দিয়েছেন,- " হে ভারত এই পারানুবাদ, পারানুকরণ, পারামুখপেক্ষা , এই দাস সুলভ দুর্বলতা, এই ঘৃণিত নিষ্ঠুরতা,  এই মাত্র  সম্বলে  তুমি  উচ্চধিকার লাভ করিবে ? পারানুকরণ নয়, দাস সুলভ দুর্বলতা নয় ,নিজেকে স্বাধীনচেতা হতে হবে ।
         তিনি আরো বলেছেন স্বাধীনতার  বীরের জন্য,  কাপুরুষের জন্য নয়  । তাই তিনি প্রতিটি ভারতবাসীকে কাপুরুষতার ত্যাগ করে বীর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ,  পুরুষদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন ভুলিও না তোমার উপাস্য উমানাথ  সর্বত্যাগী শংকর , আমরা কেউই ব্যক্তিগত সুখের জন্য নয় ,  সকলেই জন্ম হতেই মায়ের জন্য বলি প্রদত্ত । নারী জাতির উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন,  হে ভারত ভুলিও না,  তোমার নারীজাতির আদর্শ সীতা , সাবিত্রী , দময়ন্তী । পাশ্চাত্যে অন্ধ না হয়ে তিনি সীতা , সাবিত্রী , দময়ন্তীর আদর্শের কথা বলেছেন ।
         তার স্বদেশ প্রেম,  প্রবল ভাবে উৎসাহিত হয়ে উঠেছে , তিনি বলেছেন নির্যাতিত মূর্খ দরিদ্র মুচি মেথর আমাদের রক্ত আমাদের ভাই আমরা ভারতবাসী,ভ ভারতবাসী আমার ভাই,  ভারতবাসী আমার প্রান , ভারতের দেব দেবী আমার ঈশ্বর , ভারতের সমাজ আমাদের শিশু সজ্জা , আমার যৌবনের উপবন,  আমার বাধ্যকের বারানসী,  ভারতের মৃত্তিকা আমাদের স্বর্গ , ভারতের কল্যাণ আমাদের কল্যাণ ।

3. গোরা (1909 ) :  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোরা উপন্যাসটি স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত ।  তার এই উপন্যাসে তিনি ব্রিটিশ বিরোধিতা ও স্বদেশপ্রেমের আদর্শ প্রচার করেছেন । তিনি  জাতীয়তাবাদকে বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন , সত্যনিষ্ঠা ত্যাগ ও  বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য ও মিলন, মানবতা ও বিশ্বজননী ভালবাসা এবং সর্বভূতে প্রীতি,  এটাই ভারত বর্ষ , এটাই ভারতবর্ষের সত্যমূর্তি । উপন্যাসের নায়ক গোরা ভারতবর্ষের সত্য উপলব্ধি করার জন্য এবং সকলকে তা উপলব্ধি করাবার  জন্য ব্যাকুল,  আর তাই তিনি বলেছেন  সত্যের ছবি স্পষ্ট দেখতে না পেলে , লোকে আত্মসমর্পণ করবে কোন উপছায়ার কাছে ,  ভারতবর্ষের সর্বাঙ্গীণ মূর্তিটা সবার কাছে তুলে ধর, লোকে তাহলে  পাগল হয়ে যাবে,  প্রাণ দেওয়ার জন্য ঠেলাঠেলি করবে ।
       গোরা উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে কবিগুরু দেখিয়েছেন জাতপাতের গণ্ডি জাতীয়তাবোধ ও দেশপ্রেম কে আবদ্ধ করে রাখতে পারে না তাই তিনি গোরা চরিত্রটি সেভাবেই সৃষ্টি করেছিলেন,  সে জন্মগতভাবে আইরিশ কিন্তু নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পরিবারে পালিত হয়ে নিজেকে ব্রাহ্মণ হিসাবে গড়ে তুলেছিল কিন্তু পরে সে জানতে পারে সে খ্রিস্টান । তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গোরা চরিত্রের মুখ দিয়ে বলেছেন আজ আমি ভারতবর্ষীয় । আমার মধ্যে হিন্দু,  মুসলিম, খ্রিস্টান কোন সমাজের বিরোধ নেই । আজ এই ভারতবর্ষের সকল জাতি আমার জাত , সকল অন্ন আমার অন্ন ।

B. ভারতমাতা চিত্র (1905) : 1905 খ্রিস্টাব্দে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ভারতমাতা চিত্রটি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল । বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই চিত্রটি অঙ্কন করে , তার নাম দেন বঙ্গমাতা পরে ভগিনী নিবেদিতা তার নাম দেন ভারতমাতা । গৌরিক বস্ত্রে মন্ডিত , এই মাতৃমূর্তি চতুর্ভুজা,  একহাতে পুস্তক , অন্যহাতে ধনের গোছা,  অন্য হাতে শ্বেতবস্ত্র , আর এক হাতে পুষ্প মালা অর্থাৎ চিত্রের মাধ্যমে  তিনি বোঝাতে চেয়েছেন সন্তানের প্রতি মায়ের দান অন্ন ,বস্ত্র, শিক্ষা ও দীক্ষা ।
         এই চিত্রের মাধ্যমে তিনি স্বদেশবোধ ও জাতীয়তাবাদী অনুভূতি জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন ।

C.গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যঙ্গচিত্র : শিল্পী গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর আঁকা ব্যঙ্গচিত্র এর মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের সমালোচনার ঝড় তোলেন এবং ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তা বোধ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেন  । এরূপ কয়েকটি ব্যঙ্গচিত্র হলো , অদ্ভুত লোক( 1915 ), বিনোদ বস্ত্র (1917 ), নয়া হুল্লোড় (1921 ), স্বদেশী বাবুর হালচাল প্রভৃতি । এই ব্যঙ্গচিত্র গুলিতে তিনি বাঙালি বাবু সমাজের মনোভাব পাশ্চাত্যের প্রতি অন্ধবিশ্বাস,  বাঙালি নারী সমাজের দুর্দশা প্রভৃতি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছিলেন ।

Comments

Post a Comment